[ad_1]
তার
ছেলে আনন্দ জামান জানান, আল মারকাজুল ইসলামীর
স্বেচ্ছাসেবীরা শুক্রবার সকাল ৯ টার দিকে সিএমএইচ থেকে তার বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করেন। পরে কোভিড -১৯ নীতিমালা অনুযায়ী
সেখানেই গোসল-কাফনের ব্যবস্থা হয়।
“তারা
সিএমএইচ থেকে বাবার কফিন নিয়ে যান আজিমপুর কবরস্থানে। সেখানে জানাজা শেষে সোয়া ১০ টার পর বাবাকে সমাহিত
করা হয়। ”
দাফনের
আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে গার্ড অব অনার দেওয়া
হয় বলে জানান আনন্দ।
ঢাকার
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৪ টা ৫৫ মিনিটে মারা
যান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক,
গবেষক আনিসুজ্জামান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
এই
অধ্যাপক হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা,
পারকিনসন্স ডিজিজ এবং প্রোস্টেটের সমস্যা ভুগছিলেন। শেষ দিকে তার রক্তে ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল। মৃত্যুর পর নমুনা পরীক্ষায়
তার করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ আসে।
বৃহস্পতিবার
বিকালে তার মৃত্যুর খবরে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে
গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ
করেন।
রাষ্ট্রের
দুই সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক
পাওয়া আনিসুজ্জামান একাত্তরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাহাত্তরে তিনি ছিলেন কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা
কমিশনের সদস্য।
সাম্প্রদায়িকতা
ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনিসুজ্জামানের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার আনিসুজ্জামান ছিলেন ১৯৯১ সালে গঠিত গণআদালতে অভিযোগকারীদের একজন।
বাংলার
অধ্যাপকের পরিচয় ছাপিয়ে সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সংকটকালে দিকনির্দেশনামূলক
বক্তব্যের জন্য অনন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ‘আলোকবর্তিকা’
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন আনিসুজ্জামান। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি।
তার
মৃত্যুতে এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি
মো. আবদুল হামিদ বলেন, “ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন
বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতির এক
উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। ”
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার দিনগুলোতে আনিসুজ্জামানকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে।
এক
শোক বার্তায় তিনি বলেন, “তার মত বিদগ্ধ ও
জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি
হল। ”
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার সকালে আজিমপুরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জানাজার সময় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু, আনিসুজ্জামানের আখতারুজ্জামানসহ আজিমুল কয়েকজন, ভাই উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের
ধানমণ্ডি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রবিউল আলমের নেতৃত্বে প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধাকে
গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আজিমপুর কবরস্থানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পা্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী খালিদ বলেন, “সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান এর প্রয়াণে দেশ ও জাতির যে, শতবর্ষেও তা পূরণ হবার নয়।
“বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রফেসর আনিসুজ্জামান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনাবিল সমাজ হিতৈষী, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও ব্যক্তিগত মণীষা দিয়ে তিনি নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের অগ্রগণ্য পুরুষে। ”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “দেশের ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন বারংবার। মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। ”
‘আলোতবর্তিকা’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। শিক্ষাজীবনের প্রথমভাগ তার সেখানেই কাটে।
দেশভাগের সময় তিনি কলকাতার এক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এরপর আরও অনেকের মত আনিসুজ্জামানদের পরিবারও চলে আসে এপারে।
ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করা আনিসুজ্জামান কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রথম যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল, তা লেখার ভার পড়েছিল তার ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আনিসুজ্জামান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ১৯৬৫ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি পান। সেখানে তার অভিসন্ধর্ভের বিষয় ছিল ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’।
পরে ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আনিসুজ্জামান চলে যান ভারতে। সেখানে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন আনিসুজ্জামান। সেখানে দেড় যুগ শিক্ষকতা করে ২০০৩ সালে অবসর নেন। দুই বছরের মাথায় আবার তাকে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগে ফিরিয়ে আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই শিক্ষক।
দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা ও মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি একক ও যৌথভাবে অসংখ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভাষা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে; সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার। ভারত সরকার ২০১৪ সালে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে।
২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে।
[ad_2]