কোটিপতিরাও ওএমএসের তালিকায় | The Daily Star Bangla



[ad_1]

তার পরিচয়ের শেষ নেই! ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পরিচয় অনুসারে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জেলা রেস্তোরা সমিতির সভাপতি, জেলা জামে মসজিদের যুগ্ম সম্পাদক, কেন্দ্রীয় এফবিসিসিআই-এর সদস্য, জেলা এফবিসিসিআই-এর পরিচালক, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য এবং জেলা অন্ধ কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. শাহ আলম।

তবে এসব পরিচয় ছাপিয়ে এখন তার পরিচয় দাঁড়িয়েছে তিনি গরিব ও কর্মহীন। এই পরিচয়ের কারণে তার স্ত্রী, কন্যা, ভাইসহ পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনদের প্রায় সবারই নাম উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার বিশেষ ওএমএস তালিকায়। তিনি আবার নিজেও একজন ওএমএস ডিলার।

১ এপ্রিল নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের চালু করা বিশেষ ওএমএস কার্যক্রমের গেজেটে বলা হয়েছে সাধারণ কর্মজীবী ​​মানুষ যারা সাধারণ ছুটির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে যেমন: সাধারণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক, চায়ের দোকানদার, হিজড়া, ভিক্ষুক ও ভবঘুরে লোকজন এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। গেজেটে এক পরিবারের একের বেশি সুবিধাভোগী নির্ধারণ না করার শর্তের কথাও বলা হয়েছে।

তবে শাহ আলমের ক্ষেত্র কোনো নিয়ম মানা হয়নি। তার নিজের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের অধিকাংশের নাম আছে এই তালিকায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক ওয়ার্ডে বিশেষ ওএমএসের জন্য ৫০০ জনের তালিকা তৈরি করেছে। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ওএমএস ডিলার শাহ আলম। এই ওয়ার্ডের তালিকা তৈরিতেও বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

পৌরসভার বিশেষ ওএমএস-এর তালিকা দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

১০ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকার ১৬ নম্বরে রয়েছে শাহ আলমের স্ত্রী মমতাজ আলমের নাম এবং ১২ নম্বরে মেয়ে আফরোজার নাম। শাহ আলমের তিন ভাইবোন মো. সেলিম, মো. আলমগীর ও শামসুন্নাহারের নাম রয়েছে ৮, ৯ ও ২৭ নম্বরে। আরেক ভাই খোরশেদ মিয়ার ছেলে প্রবাসী নাছিরের নাম রয়েছে ৭ নম্বরে। ৩ নম্বরে রয়েছে তার শ্যালক তাজুল ইসলামের নাম। শ্যালকের স্ত্রী আসমা ইসলামের নাম ৫ নম্বরে। আরেক শ্যালকের স্ত্রী জান্নাতুল ইসলামের নাম রয়েছে ১০ নম্বরে। বোনের তিন দেবর মতিউর রহমান, মাহবুবুর রহমান ও লুৎফুর রহমানের নাম রয়েছে ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নম্বরে। আরেক শ্যালক প্রবাসী শফিকুল ইসলামের নাম রয়েছে তালিকার ১৩ নম্বরে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে গরিব-কর্মহীন মানুষের জন্যে বিশেষ ওএমএস কার্ড গরিবের রেশন কার্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এতে একজন সুবিধাভোগী ১০ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি চাল পাবেন। এই পৌরসভার মোট ৯ হাজার ৬০০ জন এই সুবিধা পাওয়ার কথা।

তবে শাহ আলম একা নন, তার মতো ৮৪ জন ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম রয়েছে পৌরসভার অন্যান্য ওয়ার্ডের তালিকায়।

উদাহরণ হিসাবে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকার ৩৪ নম্বরে আছে এ্যানী রহমানের নাম। তাদের পরিবারের দুটি পাঁচতলা ভবন আছে। তার ভাই লন্ডন প্রবাসী।

এই ওয়ার্ডের তালিকায় ৮৭, ৯২ ও ৯৪ নম্বরে রয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মকবুল হোসেনের তিন ভাই মো. আরিফ, মো. হানিফ ও মো. গোলাম রাব্বীর নাম।

নাজির মিয়া কোটিপতি হওয়ার পাশাপাশি তার দুই ছেলে বিদেশ থাকে। বজলু মিয়ার এক ছেলে প্রবাসী ও এক ছেলে ইতালিতে থাকেন, কবির মিয়া শহরের বড় কাপড় ব্যবসায়ী, নূরুল আলমের বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ চলমান। তাদের সবারই নাম আছে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায়। এছাড়া ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন দুলাল এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুণ অর রশিদের নাম রয়েছে।

১২ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন দুলাল এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুণ অর রশিদের নাম রয়েছে।

তাদের সবার সম্পত্তির হিসাব এবং দলীয় পরিচয় পরিচয় বেরিয়ে এসেছে পৌরসভার করা তদন্তে। ওএমএসের তালিকা নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে, পৌরসভা নিজেই তদন্ত করে তালিকায় থাকাদের ব্যাপারে।

এ ব্যাপারে শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তালিকার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। জানান, স্থানীয় কাউন্সিলর এ ব্যাপারে বলতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই স্থানীয় নেতা। আমাকে মহল্লার হতদরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের একটা তালিকার কথা সে বলেছে। সেই তালিকা তার (কাউন্সিলরের) কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে সেটা পৌরসভায় পাঠালে যাচাই বাছাই করে এটা চূড়ান্ত হয়েছে। আমি কোনো কার্ড বণ্টন করিনি। আমি হলাম ডিলার। ডিলার কোনো কার্ড দিতে পারে না। ’

তবে কাউতলী মহল্লা যেটা ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে সেখানকার ১০৬ জনের তালিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মেয়র, পৌর সচিব এবং কাউন্সিলরের সঙ্গে শাহ আলমেরও স্বাক্ষর রয়েছে।

গত ১১ এপ্রিল জেলা প্রশাসক হায়াৎ-উদ-দৌলা খাঁন এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে শাহ আলমকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে ওএমএস নীতিমালার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে ডিলার থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী, কন্যাসহ নিকট আত্মীয়দের নাম ওএমএসের তালিকায় থাকা ন্যায়সঙ্গত নয়।

শাহ আলমকে লেখা চিঠিতে ওএমএস নীতিমালা ২০১৫ অনুযায়ী তার ডিলারশিপ কেন বাতিল করা হবে না, দুই কর্মদিবসের মধ্যে জবাবে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

শ্রমজীবী ​​মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে খাদ্য অধিদপ্তর গত ৫ এপ্রিল বিশেষ ওএমএস কর্মসূচি চালু করেছে যাতে দরিদ্ররা প্রতি কেজি চাল ১০ টাকায় কিনতে পারে।

কিন্তু একের পর এক চাল আত্মসাতের অভিযোগ ওঠায় সরকার ১৫ এপ্রিল কর্মসূচি স্থগিত করে এবং দরিদ্রদের জন্য কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে তারা কম দামে চাল কিনতে পারে। তবে সাময়িক বিরতির পরে সরকার ওএমএস কর্মসূচি আবার চালু করেছে।

তালিকা তৈরিতে অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে, পাশাপাশি আমরাও তার সকল সরকারি সুবিধা ও পদ-পদবি বাতিলের জন্য অনুরোধ করব। তাছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেলা আওয়ামী লীগও ব্যবস্থা নেবে।

১৫ এপ্রিল যখন ওএমএস কর্মসূচি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়, তখন প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে চাল চুরির খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। অভিযোগ উঠছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের জন্য ৪৯ জন প্রতিনিধি (১৮ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ২৯ ইউপি সদস্য, একজন জেলা পরিষদ সদস্য এবং একজন পৌর কাউন্সিলর) -কে বরখাস্ত করেছে।

এছাড়া দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৫৪ হাজার কেজি ভর্তুকির চাল চুরির অভিযোগে স্থানীয় সরকারের ১৪ জন জনপ্রতিনিধিসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে ১৫ টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

[ad_2]